কেস স্টাডি-১:
পহেলা বৈশাখ। আনুমানিক সন্ধ্যে ৬ টা। টিএসসির মোড়। প্রচুর ভিড়। এমন সময় মাইক্রোবাসের সামনে জটলা দেখে এগিয়ে যায় লিটন নন্দীসহ কয়েকজন । জটলার ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় একটি মেয়ে আর তাঁর স্বামীকে । ২৬-২৭ বছরের মেয়েটিও নববর্ষের শাড়ি পড়ে ঘুরতে বের হয়েছিলো স্বামীর সাথে। সেখান থেকে যখন তাঁকে উদ্ধার করা হয় গায়ে কোন শাড়ি ছিল না মেয়েটির। স্বামীকে মারা হচ্ছিল বেধড়কভাবে। সম্ভ্রম বাঁচাতে উদ্ধারকারীদের মধ্যে একজন মেয়েটিকে তাঁর গায়ের পাঞ্জাবী খুলে পড়িয়ে দেন । ওদিকে সম্ভ্রমহরণকারীর একজন বলছিলো এমন দৃশ্য আর পাওয়া যাবে না। ভিডিও করেন তাড়াতাড়ি।
কেস স্টাডি-২:
ছোট ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে এসেছিলেন টিএসসিতে। যা নিয়ে বাসায় ফেরত গেলেন কল্পনাও করেন নি তিনি । গ্যাংদের হাতে যখন পড়লেন তখন তিনি চিৎকার করে বলছিলেন..”ভাই, আমার সাথে আমার বাচ্চা আছে ,আমাকে ছেড়ে দেন” ।
এমন অনেক ঘটনাই ঐ দিন ঘটেছে টিএসসিতে। হতভাগ্য মেয়েগুলোকে ঘিরে উচ্চস্বরে বাজানো হচ্ছিল ভুভুজেলা আর্তচিৎকার যাতে বাইরে শোনা না যায় । শ্রেফ শিকার ধরে ফেলা আদিম মানুষ যেন।
১৯ টা সিসিটিভি ক্যামেরা , তারপরও আমাদের পুলিশ বাহিনীর হাতে কোন প্রমাণ নেই, কোন অপরাধি ধরা পড়ে নি । ধরা পড়েছিলো যে কজন তাদেরও ‘ভাই’ ডেকে ছেড়ে দেয়া হল। যখনই ভাবছি এসব কথা ক্ষোভ আর লজ্জায় চোখের জল আটকাতে পারছি না। এটাইকি আমার জন্মভূমি? বিশ্বাস করতে পারছি না এগুলো ১৯৭১ সালের নয় , এই ২০১৫ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের ঘটনা ।
বাংলার ইতিহাসে মহান মুক্তিযুদ্ধ যেমন মহাব্রত তেমনি বাংলা বর্ষবরণও একটি অনন্য মাধ্যম যা শ্রেণীকরণ ভুলে এক ভিত্তিমূলে দাড় করায়। কিন্তু সেসব নিয়েও হনন ও হরন খেলা শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে। আমরা দেখেছি ২০০১ সালে রমনার বটমুলের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হয়েছিল। কারন বাঙালীতে বাঙালীতে যেন ঐক্য না থাকে, প্রতি পদেপদে শুরু হয় হানাহানি। ভেঙ্গে পরে নিজস্বতা। আমাদের যেন পরিচয় দেবার মত নিজেদের কিছু না থাকে তারই ‘মসলা’ এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আঘাত। ইতিমধ্যে দেখেছি পহেলা বৈশাখে টিএসসিতে শ্লীলতাহানির ঘটনা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা। প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি লিটন নন্দী বলছেন, তিনি সেদিন বেশ কয়েকজন নারীকে বস্ত্রহরণ করতে দেখেছেন।
আমাদের নিরাপত্তা দেবার কথা যাদের তাদের বোল কিন্তু এবার যথারীতি ভোলে পরিণত হয়েছে। তারা (পুলিশ) বলছে, বিচ্ছিন্ন কয়েকটি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটলেও সেদিন বস্ত্রহরণের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। পুলিশের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে জোরালো দাবি জানানো হচ্ছে। কোনো কোনো মিডিয়া ঘটনাটি নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। পুলিশ বলছে, ‘বিচ্ছিন্নভাবে সেদিন দু’একটি উত্ত্যক্তের ঘটনা ঘটেছে। টিএসসি এলাকায় স্থাপিত পুলিশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে এমন দৃশ্য ধরা পড়েছে। এর বেশি কিছু নয়।’ এমন নীতিবোধহীন বক্তব্য পেতে আমাদের ট্যাক্সের পয়সায় বাংলাদেশে যে পুলিশ পালন করি সে তো নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে অন্তত পহেলা বৈশাখের ঐ ঘটনার প্রেক্ষিতে এভাবে বলা অন্যায় কাজ করেছে প্রশাসন বলে মনে করি। কারন ঐ ঘটনা যদিও হতে পারে রাজনৈতিক ঘুটি চাল। তবে প্রশাসনেরও রাজনীতি করার এখতিয়ার কে দিয়েছে। ঘটনা ঘটবে আর আপনারা উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে যাবেন সেটা কতটা যোগ্যতা সম্পন্ন? বাংলাদেশে যখনই র্স্পশকাতর ঘটনা ঘটেছে তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে পুলিশ বলেছেন বিএনপি করেছে, আবার বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে বলছেন আওয়ামী লীগ করেছে। এটা কি প্রশাসনের কাজ? টাকা নেয়ার সময়েতো কানা কড়ি কম নেন না তাহলে বাংলাদেশে আমার মা- বোন ও আমাদের সম্ভ্রম রক্ষা কেন পাবে না? পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে, টিএসসি এলাকায় স্থাপিত ক্যামেরায় উত্ত্যক্তের দৃশ্য ধরা পড়লেও বস্ত্রহরণের দৃশ্য কেন ধরা পড়লো না? সেদিন প্রকৃতপক্ষে কি ঘটেছিল টিএসসিতে? গণমাধ্যমের বক্তব্যে সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু ধারণা পাওয়া গেছে। পুলিশের সিসিটিভি ফুটেজের কোথাও তারা বস্ত্রহরণের মতো ঘটনা দেখেননি। এমন ‘ফুলিশি’ বক্তব্যের পরও কিন্তু ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আছেন। প্রতক্ষদর্শী লিটন নন্দী গনমাধ্যমে বলেছেন সেটা অনায়াসে বিবেচনা যোগ্য। নন্দী বলেছেন, তিনি বস্ত্রহরণের শিকার এক নারীকে নিজের পাঞ্জাবি দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন। পুলিশের বস্ত্রহরণের বিষয়ে তার যুক্তি, পুলিশ দায়িত্ব পালন করলে ফুটেজে যাদেরকে যৌন হয়রানির দায়ে পুলিশ পিটাচ্ছিল তাদেরকে কেন গ্রেফতার করা হয়নি? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কিভাবে গাড়ি চললো এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন গেট বন্ধ থাকার কথা থাকলেও কেন খোলা ছিল? ফুটেজে যদি অভিযুক্তদের চেহারাই ভালোভাবে বোঝা না যায় তাহলে এত মানুষের ভেতরে কি ঘটেছিল তা কিভাবে বোঝা যাবে? এসব যুক্তি তুলে ধরে ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে লিটন নন্দীর ভাষ্য, সেদিন সাড়ে পাঁচটার দিকে শাহবাগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আসার পথে রাজু ভাস্কর্যের কাছে বেশ কয়েকটি স্থানে জটলা দেখি। এসব জটলা থেকে নারীদের চিৎকার শুনতে পাই। কাছে গিয়ে দেখি বিভিন্ন স্থানে সংঘবদ্ধ কয়েকটি চক্র নারীদেরকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করাসহ বস্ত্রহরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে। তখন আমি ও আমার সংগঠনের কয়েকজন সেখানে গিয়ে তাদেরকে থামানোর চেষ্টা করি। সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৬টা ২০ মিনিটের দিকে রাজু ভাস্কর্যের পাশে দেখতে পাই একটি বড় জটলা। তার ভেতর থেকে একজন নারীর বাঁচাও বাঁচাও আওয়াজ আসছে। ভেতরে শ্লীলতাহানি হচ্ছে বিষয়টি বুঝতে পেরে বখাটেদের ধাক্কা দিয়ে আমরা ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করি। ঢুকে দেখি, কালো পাঞ্জাবি পরিহিত একজন, মহিলার বয়ফ্রেন্ড অথবা স্বামী হতে পারে- সে বিবস্ত্র ওই নারীকে জড়িয়ে রেখেছে। তখন আমি গায়ের পাঞ্জাবি খুলে ওই মহিলাকে দেই। পরে তাকে রিকশায় উঠিয়ে দিলে- রিকশার ফুট উঠিয়ে ওই নারী পরনে থাকা অফ হোয়াইট শাড়িটি পরে আমার পাঞ্জাবিটি ফেরত দেয়। টিএসসির বেশ কয়েকটি স্থানে একই ঘটনা ঘটলে ঠেকাতে গিয়ে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমার হাত ভেঙে যায়। এদিকে নির্যাতনের প্রত্যক্ষদর্শী রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইশাত কাশফিয়া ইরার বক্তব্য, ওই দিন আমি ভাইয়ের সঙ্গে হল গেটে দাঁড়িয়েছিলাম। এমন সময় রিকশা নিয়ে একটি মেয়ে হল গেটে আসে এবং রিকশা থেকে নেমে হলের গেস্টরুমের দিকে দৌড় দেয়। আমিও তার পেছনে পেছনে গিয়ে দেখি ওই মেয়েটির ব্লাউজটি ছেঁড়া। চুলগুলো ছিল এলোমেলো। পরনের শাড়িটিও ছিল উল্টাপাল্টা অবস্থায়। এ সময় তিনি কথা বলতে পারছিলেন না। পরে পরণের কাপড় ঠিক করে দেয়ার সময় ওই নারী জানান, তিনি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপিতে কাজ করেন এবং আজিমপুরে থাকেন। এছাড়া ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একজন হকার জানিয়েছেন, তিনি ওই দিন বস্ত্রহরণের ঘটনার সময় পাশেই ছিলেন এবং একজনকে পাঞ্জাবি খুলে বস্ত্রহীন ওই নারীকে জড়িয়ে দিতে দেখেছেন। এত প্রমান থাকতেও যখন প্রশাসন বলে বস্ত্রহরণের কোন ঘটনা ঘটেনি তখন ভাবনা এসে যায়, আমরা আমাদের সময়ে নেই। অন্য কোন সময়ে বেচে আছি। যে সময়ের কোন পরিচয় নেই। যে সময়ে মানুষের জন্ম ও মৃত্যু দুটোই অনাকাক্সিক্ষত। তবে এটুকু ধারনা করা সঙ্গত যে, নববর্ষ উৎসবকে নিবৃত করতে কেউ না কেউ পরিকল্পনা করছেন। বস্ত্রহরণের ঘটনার একটি অনুল্লেখিত বক্তব্য আছে হয়তো। আমার মনে হয়, পরিকল্পকরা এটা বুঝাতে চেয়েছে সম্ভ্রম বাচাতে আগামী উৎসবে কোন অভিভাবক তার কন্যাকে এধরণের বাঙালীয়ানার উৎসবে যেতে দিবেন না। ফলে দিান্তে দিন জনশূণ্য উৎসব বন্ধ হয়ে যাবে। এধরনের চক্রান্ত করতে পারে যারা মুক্তমনাদের খুন করছে। কিন্ত স্বাধীন বাংলাদেশে এমনটি কি আদৌ হওয়া সম্ভব? আর পুলিশ, প্রশাসন বা সরকারের কি ভূমিকা দেখছি ঘটনার পর। শুধু এক খাত থেকে দায় এড়াতে অন্যত্র সরানোর কথা চালাচালি চলছে।
আমরা এগুলো পছন্দ করি না। কিন্তু কেউতো নেই ধর্ষিতার পক্ষে। এভাবে বাংলাদেশে হনন ও হরনের আয়ুস্কাল বাড়তে থাকলে স্বাধীনতা আর রক্তের দাম রইল কিভাবে? আচ্ছা একাত্তরের ধর্ষণকারীদের যেরকম ফাসি হচ্ছে, ঠিক সেরকমভাবে এই ধর্ষণকারীদের কি ফাসি হবে? ফাসি না হোক, কোন বিচার হবে এদের? নাকি এখনকার ধর্ষণকারীদের ঘৃণা করার মত কেউ নাই, নাকি এখনকার ধর্ষণকারীরা বেশি আতংকজনক না।
লেখক: ওয়াহিদা আলম
No comments:
Post a Comment