জীবনানন্দ দাশ |
লিখেছেন: পার্থ সারথি
একজন কবি তার কোন একটি কবিতায় কি বলতে চেয়েছেন তা বিশ্লেষণ করতে হলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে রচনার সময়,পরিবেশ ,প্রতিবেশ সম্পর্কে। অর্থাৎ,কবির ভাবনা কোন কোন বিষয়ে আবদ্ধ বা অবর্তিত তা আমাদের বুঝতে হবে। যদিও তা থেকেই যে আমরা কবির ভাবনাটাকে যথার্থ ভাবে উপলব্ধি করতে পারবো এমন নাও হতে পারে। এখানে কবিতা সম্পর্কে কবির বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যগুলোকে একত্রিত করেও আমরা বোঝার চেষ্টা করতে পারি কবি কি বলতে চেয়েছেন। মূলত আমরা যে কবিতাটা নিয়ে আলোচনা করবো প্রথমেই সেটা রচনার সময়টাকে নির্দিষ্ট করি। ‘পরষ্পর’ কবিতাটি রচিত হয়েছে ১৩৩৩ সালে এবং প্রথম প্রকাশিত হয়েছে তৎকালীন সময়ের উল্লেখযোগ্য পত্রিকা ‘প্রগতি’ তে। জীবনানন্দ দাশ এর প্রকাশিত কাব্যগন্থের মধ্যে যে কাব্যগন্থটি সবচাইতে বেশী আলোচিত,সমালোচিত হয়েছে এ কবিতাটি সেই ‘ধূসর পান্ডুলিপি’তে অন্তর্ভুক্ত। আমরা যদি
সেই সময়টাকে ধরতে চাই তাহলে দেখা যাবে তাঁর ব্যক্তি জীবনের চরম টানাপোড়েন আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠবে। তবে কি আমরা ভাববো সেই টানাপোড়েন ই প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর তৎকালীন
কবিতাতে?
জীবনানন্দ তাঁর সমগ্র কবিতায় প্রেম-প্রাণ-স্বপ্নের স্থির নিষ্কম্প সুর তুলে ধরেছেন। মানুষের জীবনের নিরবছিন্ন আয়োজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যেন তাঁর কবিতার।
জীবন মানেই প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির মেলবন্ধন।
জীবনানন্দ তার কাব্যভূবনের সমগ্রতায় যে চিত্রকল্পনার ক্যানভাস এঁকেছেন তা একটা স্বাতন্ত্র নিয়েই আমাাদের কাছে প্রতিভাত। আর তা থেকে সহজেই বোঝা যায় তাঁর সাহিত্যের মূলে রয়েছে সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবনের প্রাত্যহিক টানাপোড়েন আর ব্যক্তিগত অন্তর্জালা।
রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দকে বলেছেন চিত্রলতা আর চিত্রকল্পের কবি। চিত্রকল্পের যে রূপময়তা,চিত্রকর্মের যে লাবণ্য জীবনানন্দ তাঁর কবিতার পরতে পরতে চিত্রিত করেছেন ধূসর পান্ডুলিপি কাব্যের “পরষ্পর” কবিতা এর বাইরে নয়।নাবালক শিশুকে কোলের কাছে নিয়ে ঘুম পাড়ানোর জন্য মা রূপকথার গল্প শোনায়,কবি যেন সেই একই মমতায় গল্পের ছবি এঁকে,কল্পনার রং মাখিয়ে আমাদের বোধের দরজায় এনে উপস্থাপন করেছেন। রূপকল্প, চিত্রকল্পের এক অনন্য নিদর্শন যেন তাঁর “পরষ্পর” কবিতা। এ চিত্রকল্পের মাধ্যমে আমরা কবি আত্মার পরিচয় লাভ করতে পারি,উপলদ্ধি করতে পারি তার কল্পনা প্রবনতার।এখানে রূপায়িত প্রতিটি ইমেজ যেন তাঁর ইমাজিনেশনে পৌঁছানোর রাস্তা। এই ইমেজ তৈরী করবার জন্য কবি কতগুলো মোটিফ নির্ধারণ করে নেন নিজের মত করে। আর এই মোটিফ গুলোকে সাজিয়েই চলে তাঁর কাব্যিক আলপনা আঁকা। জীবনানন্দের মোটিফ গুলোকে আমরা সহজেই চিহ্নিত করতে পারি--যেমন আলো,অন্ধকার,প্রেম,নিসর্গ,সময়,ইতিহাস চেতনা ইত্যাদি।
এ কবতিায় প্রত্যেকেই যাকে খুঁজে ফিরেছেন তার যেন কোনদিন ছিল না হৃদয়।
পৃথিবীর পথে পথে তার রূপকেই যেন সবাই খুঁজেছেন। চির যৌবনকে যেন কবি খুঁজে ফিরেছেন এ কবিতার ছত্রে ছত্রে। কাল্পনিক এক রাজকন্যাকে ঘুম থেকে জাগানোর যে চেষ্টা আজীবন করে যায় মানুষ ,তার ঘুম যেন আর ভাঙেই না। যেমন------
কবি কহিলেন----
“আমি গিয়ে তাই তারে পারিনি জাগাতে”
কহিল কুমার----
আমার চোখের ঘুম খসেছিল হায়-
বসন্তের দেশে
জীবনের-যৌবনের! আমি জেগে ,ঘুমন্ত সে!
বলিল আর একজন----
হাতে হাত ধরে
সেইখানে,কখন জেগেছে তারা- তারপর ঘুমালো কখন!
কে যেন উঠিল বলে-----
মায়াবীর ঘরে
ঘুমন্ত কন্যার কথা শুনেছি অনেক আমি;দেখিলাম তবু চেয়ে চেয়ে
এ ঘুমানো মেয়ে
পৃথিবীর-মানুষের দেশের মতন;
এ রাজকন্যার ঘুম তারা কেউই ভাঙাতে পারেনি।
প্রতিমূহুর্তে তিনি সুন্দরকে ছুঁতে চেয়েছেন,সুন্দরকে আগলে রাখতে চেয়েছেন। অথচ প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন বারবার। তবু অনাগত কবিকে আহ্বান জানিয়েছেন এ চির যৌবনা রাজকন্যাকে ঘুম থেকে জাগাতে তাদের সাবধান করে দিয়ে---
আবার তো এসে যাবে ;
এক কবি-তন্ময়,শৌখিন
আবার তো জন্ম নেবে তোমাদের দেশে
আমরা সাধিয়া গেছি যার কথা-পরীর মতন এক ঘুমানো সে মেয়ে
হীরার ছুরির মত গায়ে
আরো ধার লবে সে শাণায়ে!
“পরষ্পর” কবিতায় কবি আমাদের একটি পরিচ্ছন্ন রূপকথা শুনিয়েছেন যেন। সেটা যদি ভাবি কবির জীবনের রূপকল্প অথবা আমার ,তোমার বা অনেকের। মানব জীবনের একাকীত্বের সুর যা প্রাগৈতিহাসিক ধারবিাহিকতায় প্রবহমান তার এক চলমান ছবি এঁকেছেন কবি। এখানে কবি,কুমার, আরেকজন,অন্য কেউ যেন একই তানে বেঁধে গেছে জীবনের সুর।
No comments:
Post a Comment