Thursday, May 28, 2015

‘দাসপ্রথা’র নূতন রূপ


দাসপ্রথার কথা শুনিলে শুরুতেই মনে হইতে পারে, তাহা তো দূর অতীতের কথা—এই আধুনিক সময়ে সভ্যতার ওই কলঙ্ক মুছিয়া গিয়াছে বহু পূর্বেই। দাসপ্রথা পূর্বের মতো নাই, তাহা সত্য বটে, কিন্তু এক্ষণে আমরা স্পষ্ট করিয়া লক্ষ্য করিতেছি—পুরাপুরি বিলুপ্ত হয় নাই মানবেতর দাসপ্রথা। প্রকৃতপক্ষে দাসপ্রথার আধুনিক রূপ এমনই ছদ্মবেশী, এমনই ছলনাময় যে, তাহাকে স্বাধীন জীবন বলিয়াই ভ্রম হয়। সমপ্রতি
এক ব্রিটিশ সমীক্ষায় জানা গিয়াছে, পূর্বের তুলনায় সেখানে প্রায় পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে আধুনিক ‘দাস’-এর সংখ্যা। চাষের জমি, কলকারখানা, মাছধরা নৌকার শ্রমিক—প্রভৃতি কাজের ক্ষেত্রগুলিতে বহু সংখ্যক অসংগঠিত মানুষকে নামমাত্র বেতনে, এমনকি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিনা বেতনেও খাটাইয়া নেওয়া হইতেছে। ওই সমীক্ষা জানাইতেছে, তুলনামূলকভাবে অনগ্রসর বিভিন্ন দেশ হইতে আসা পুরুষ ও নারীরাই মূলত এই শোষণের শিকার। ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশেই যদি এমন দাসপ্রথা এখনও বজায় থাকে, তাহা হইলে তুলনামূলক অনগ্রসর দেশগুলির যে কী অবস্থা—তাহা সহজেই অনুমেয়। এই উপমহাদেশে অতি প্রাচীনকাল হইতেই দাসপ্রথা বজায় ছিল। সেইসময় সারা বিশ্বেই দাস আমদানি ও রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হইত।





গরু-ছাগল বেচাকেনার মতোই দাস-দাসী ক্রয়-বিক্রয়ের জন্যও হাট বসিত নিয়মিত। বিভিন্ন গবেষণাসূত্রে জানা যায়, ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ অবধি এই ভূখণ্ডে আফ্রিকান ‘হাবশি’ ও ‘কাফি’ নামে পরিচিত দাস-দাসী আমদানি করা হইত। রপ্তানি হইত ইউরোপীয় উপনিবেশগুলিতে, যেখানে বাগান ও কৃষিকার্যাধীন দাসের সংখ্যাই বেশি ছিল। তত্কালীন ব্রিটিশ সরকার দাসপ্রথাকে নিরুত্সাহিত করিয়া ১৮৪৩ সালে দি ইন্ডিয়ান স্লেভারি অ্যাক্ট, যাহা ১৮৪৩ সালের পঞ্চম আইন নামে পরিচিত, প্রণয়ন করে। সেই আইনে নিষিদ্ধ করা হয় দাস আমদানি-রপ্তানি। স্বভাবতই দাসপ্রথা একদা সভ্যতার মুখে কালিমা লেপন করিয়াছে, ভূলুণ্ঠিত করিয়াছে মানবতার জ্যোতির্ময় মানসসত্তাকে। অতঃপর বিগত প্রায় পৌনে দুইশত বত্সরে বিশ্বের যে অত্যাধুনিক রূপ আমরা দেখিতেছি, সেখানে ‘মানবতাবাদ’ই সকল কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান পাইয়াছে। তাহাতে দাসপ্রথা দৃশ্যত ইতিহাসের পাতায় স্থান পাইলেও তাহা যেন ভিন্নরূপে বহাল রহিয়াছে বিশ্ব সমাজব্যবস্থার অন্ধকার মানসকুঠুরিতে। 



এই উপমহাদেশে দাসপ্রথার আধুনিক ছদ্মরূপে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দারিদ্র্যপিষ্ট নারী ও শিশুরা। বিবাহের নাম করিয়া ফুসলাইয়া হতদরিদ্র ঘরের মেয়েদের যৌনপল্লিতে বিক্রি করিবার পরিসংখ্যানও আমাদের চমকাইয়া দেয়। তাহা ছাড়া শিশুশ্রমিকদের সংখ্যাও আমাদের দেশে অগণন। সামান্য খাবারের বিনিময়ে বিবিধ শ্রমের কাজ করে তাহারা, যাপন করে নিকৃষ্ট মানবেতর জীবন। এককালে দাসপ্রথার শিকার মানুষকে ‘মানুষ’ই মনে করা হইত না। বরং মনে করা হইত মনুষ্য হস্তপদবিশিষ্ট হীন জীবমাত্র। সেই হীন অবস্থা হইতে এই আধুনিক সভ্যতা দৃশ্যত উত্তরণ ঘটাইতে পারিলেও প্রকৃতপক্ষে পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে দাসপ্রথা খানিকটা মানবিক হইয়া রূপবদল করিয়াছে মাত্র। আশার কথা হইল, দাসপ্রথার এই ছদ্মরূপ নির্মূলে বিশ্ববিবেক ও সভ্যতার মানবিক সত্তা নূতন করিয়া ভাবনাচিন্তা করিতেছে। বিশেষ করিয়া নারী ও শিশুশ্রমিকদের পুনর্বাসন এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মানবতাবাদী প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকা উত্তরোত্তর বাড়িতেছে। কিন্তু সচেতন হইতে হইবে আমাদের সবাইকেই। কেননা, সভ্যতার নন্দনকাননের মূলমন্ত্র হইল—সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।

No comments:

Post a Comment