বরিশাল নগরীর মনসা বাড়ি মন্দিরে অনুষ্ঠিত রয়ানি আসর |
দেবাশীষ চক্রবর্ত্তী
সাধারণত লিখিত নয় বলে লোকসংগীত একজন মানুষ হতে ভিন্নমানুষে এর অবয়ব পরিবর্তিত হয়ে থাকে। সময় ও স্থানের বিভিন্নতায় সংগীতের বিষয়বস্তুতেও পরিবর্তন আসে। সমাজ সংস্কৃতির বিবর্তনেও গানের কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটে। লোকসংগীত হয়ে ওঠে বৈচিত্রময়। এগুলোর বিচিত্রতা রয়েছে সুরে, কথায়, তালে ও পরিবেশনের পরিবেশে। বাংলাদেশের লোকসংগীতে এত ভিন্নতা রয়েছে বলে এগুলোর বিজ্ঞানম্মত বিশ্লেষণের জন্য বিষয়োপযোগি শ্রেণীবিন্যাস প্রয়োজন।
সংগীত পরিবেশনের স্থিতিকাল বা দীর্ঘসূত্রিতার ভিত্তিতে বরিশাল
অঞ্চলের লোকসংগীতকে বারমেসে (যা বছরের যে কোন ঋতু বা সময়ে গীত হয়), সাময়িকী (বছরের কোন বিশেষ সময়ে অনুষ্ঠান বা পার্বণকে ভিত্তিকরে যে গানগুলো পরিবেশিত হয়) এবং অকস্মাৎ (হঠাৎ করে যে কোন পরিবর্তনের উপর ভিত্তিকরে গীত হয় এবং যেগুলো অকস্মৎই অবলুপ্তি পেয়ে যায়) এমন ভাগে ভাগ করা যায়। বিষয়বস্তু এবং তাল লয়ের ভিত্তিতে বরিশাল অঞ্চলের লোকসংগীতকে আঞ্চলিক, ব্যবহারিক, আনুষ্ঠানিক, কর্মসংগীত, প্রেমসংগীতে শ্রেণীবিন্যাস করা যেতে পারে।
১৯৫৭ সালে বরিশাল সাহিত্য সম্মেলনের লোকসাহিত্য শাখার সভাপতির ভাষণে ড. মুহম্মদ এনামুল হক লোকসংগীতের ১০টি শ্রেণীবিভাগের কথা উল্লেখ করেন-১. প্রেমসংগীত, ২. নৃত্যসংগীত, ৩. সহেলাসংগীত, ৪. শ্রমসংগীত, ৫. কৃষিসংগীতি, ৬. অনুষ্ঠান সংগীত, ৭. পটুয়াসংগীত, ৮. শোকসংগীত, ৯. ভক্তিসংগীত, ১০. তত্ত্বসংগীত। বরিশাল অঞ্চলের লোকসংগীতকে আধ্যাত্মিক প্রেক্ষাপটেরভিত্তিতে ৩ শ্রেণীতে বিভক্তি করা যেতে পারে- ১. ধর্মীয় ২. ধর্ম নিরপেক্ষ বা ব্যবহারিক ৩. কল্পনাশ্রয়ী। আবার নিগূঢ়তত্ত্বেরভিত্তিতে বরিশাল অঞ্চলের লোকসংগীতকে আধ্যাত্মিক ও পার্থিব ভাগে বিভক্ত করা যায়।
এ অঞ্চলের জনজীবনে বিভিন্ন যুগ পর্যায়ে বিচিত্রতর জনগোষ্ঠী ও ধর্মের প্রভাবে লোকসংগীতে এসেছে বৈচিত্র। সময়ের বিবর্তনে রূপান্তর, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ঘটেছে প্রচুর। যার ফলে আঞ্চলিক লোকসংগীতগুলো একটি জটিলাবর্তের সৃষ্টি করেছে। ফলশ্র“তি হিসেবে বিভিন্ন সংগীতের মধ্যে সুস্পষ্ট শ্রেণীবিন্যাস অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামগ্রীকভাবে দেখা যায়, ধর্ম এদেশের লোকসংগীতকে সর্বাধিক প্রভাবিত করেছে এবং একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনেরনিমিত্তে সংগীতগুলো সৃষ্টি হয়েছে। তাই বরিশাল অঞ্চলের লোকসংগীতকে ধর্মীয় প্রেরণার প্রেক্ষিতে গীত হওয়ারভিত্তিতে শ্রেণীবিন্যাস করা যায়।
বরিশাল অঞ্চলের লোকসংগীতের উপর এই স্থানের জলবায়ু, ভূ-অবয়ব, নদ-নদী, উদ্ভিদ, জীব-জন্তুর প্রভাব লক্ষণীয়। প্রাকৃতিক পরিবেশের পাশাপাশি এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিবেশেরভিত্তিতে সৃষ্ট লোকসংগীতকে নিম্নোক্ত ধারায় শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে-
ক) অপার্থিব পরিবেশে সৃষ্ট লোকসংগীতঃ
ভাবমূলক লোকসংগীত
জাগরণমূলক লোকসংগীত
খ) পার্থিব পরিবেশে সৃষ্ট লোকসংগীতঃ
বস্তুগত লোকসংগীত
স্থানগত লোকসংগীত
অপার্থিব পরিবেশের ভাবমূলক লোকসংগীতগুলোকে আবার দেব-দেবী ও পীর-পীরানি ভিত্তিক, উৎসব-অনুষ্ঠানভিত্তিক, সাধনাভিত্তিক শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। এছাড়া জাগরণমূলক লোকসংগীতকে ঐতিহাসিক বা ইতিহাসনির্ভর এবং দেশপ্রেমমূলক ভাগে ভাগ করা যায়। একই ভাবে পার্থিব পরিবেশের বস্তুগত লোকসংগীতগুলোকে মানবসৃষ্ট উপাদানভিত্তিক যা আবার দেশীয় এবং বৈদেশিক বস্তুভিত্তিক ভাগে ভাগকরা যায়। আর স্থানগত পরিবেশের লোকসংগীতগুলো গ্রাম এবং নগরকেন্দ্রিক।
ঘটচিত্রের নিদর্শন মনসার ঘট এখনো পূজায় ব্যবহার করা হয় |
১৯৮২ সালে বাংলাএকাডেমি থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের লোকসংগীত ও ভৌগলিক পরিবেশ গ্রন্থে হাবিবুর রহমান পর্যবেক্ষণ ও প্রশ্নোত্তর জরিপ এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ১০টি লোকসংগীতাঞ্চলে রূপায়িত করেছেন। তাঁর মতে, বৃহত্তর বরিশাল, পটুয়াখালী জেলা এবং শরিয়তপুর ও মাদারীপুর অঞ্চল হল রয়ানী অঞ্চল। তিনি বলেন
সমগ্র বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা এবং ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর শরিয়তপুর মহকুমা নিয়ে রয়ানী সংগীতাঞ্চল গড়ে উঠেছে।
বরিশাল অঞ্চলের জনজীবনে বিভিন্ন যুগপর্যায়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও ধর্মের প্রভাবে লোকসংগীতে এসেছে বৈচিত্র। সময়ের বিবর্তনে রূপান্তর, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ঘটেছে প্রচুর। যার ফলে আঞ্চলিক লোকসঙ্গীতগুলো একটি জটিলাবর্তের সৃষ্টি করেছে। দেখা যায়, ধর্ম এঅঞ্চলের লোকসঙ্গীতকে সর্বাধিক প্রভাবিত করেছে এবং একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনেরনিমিত্তে সঙ্গীতগুলো সৃষ্টি হয়েছে। সময় ও স্থানের বিভিন্নতায় লোকসঙ্গীতের বিষয়বস্তুতে আসে পরিবর্তন। সমাজ সংস্কৃতির বিবর্তনেও গানের কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটে। লোকসঙ্গীত হয়ে ওঠে বৈচিত্রময়। বিচিত্র হয়ে ওঠে সুরে, কথায়, তালে ও পরিবেশনের পরিবেশে।
বাংলাএকাডেমী থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত ও ভৌগলিক পরিবেশ গ্রন্থে হাবিবুর রহমান পর্যবেক্ষণ ও প্রশ্নোত্তর জরিপ এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ১০টি লোকসঙ্গীতাঞ্চলে রূপায়িত করেছেন। তাঁর মতে, সমগ্র বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা এবং ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর শরিয়তপুর নিয়ে রয়ানী সঙ্গীতাঞ্চল গড়ে উঠেছে। রয়ানী বা ভাসান গান মূলতঃ চাঁদসওদাগর, লক্ষীন্দর ও বেহূলার প্রচলিত লোককাহিনীভিত্তিক মনসাদেবীর মহাত্ম্যসূচক সংগীত। সর্পদেবী মনসার মহাত্ম্য প্রকাশক ভক্তিসংগীত বলে এই গানকে মনসারগান নামেও অভিহিত করা হয়।
আগৈলঝাড়ার গৈলা ইউনিয়নের ফুল্লশ্রী গ্রামে মধ্যযুগের কবি বিজয় গুপ্ত প্রতিষ্ঠিত মনসা মন্দির সংলগ্ন প্রাচীন দালানে স্থাপিত ফলক |
রয়ানীর আভিধানিক অর্থ নেই। তবে বরিশাল-পটুয়াখালী এলাকায় স্মৃতিকথা বা মহাত্ম্যগাঁথা, বিশেষ করে সর্পদেবী মনসার জন্ম থেকে লক্ষীন্দরের পূর্নজীবন প্রাপ্তির মধ্যে দিয়ে তার দেবত্ব প্রচেষ্টার গীতি-কাহিনীই রয়ানী নামে পরিচিত। এদের রচয়িতাদেরকে রয়ানীকার বলা হয়। এ দৃষ্টিকোন থেকে রয়ন (অর্থাৎ স্মৃতিকথা) শব্দ হতে রয়ানীর উদ্ভব ঘটেছে বলা যায়।
অন্যদিকে সারারাত্রি এ গান পরিবেশিত হয়ে থাকে বলে রজনী শব্দ হতে রয়ানী গানের উৎপত্তি হতে পারে। তবে অধিকাংশের অভিমতঃ রয়ানী যাত্রা (যাত্রার অর্থ যখন একস্থান হতে অন্যস্থানে রওয়ানা হওয়া) শ্রেণীর গান। ফলে যাত্রার পূর্ববঙ্গীয় কথ্য ভাষা প্রকাশক রওনা শব্দ হতে রয়ানী শব্দটির উৎপত্তি। এ ছাড়া রয়ানীগান চাঁদ সওদাগরের ব্যবসা সংক্রান্ত ও বেহুলার স্বামী লক্ষীন্দরের পূনর্জীবন প্রাপ্তির অভিযাত্রামূলক সংগীত বলে (অভিযাত্রা-যাত্রা-রওয়ানা-রওনা-রয়ানী) রয়ানী নামকরণ হয়েছে।
সর্প পূজার প্রথা অত্যন্ত প্রাচীন। সর্পকে সর্প হিসাবে পূজা না করে সর্পদেবতা বা সর্পাত্মারূপেই পূজা করা হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সর্প পূজার প্রচলন আছে। অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের সর্প টোটেম আছে; কিন্তু সর্প পূজার প্রথা নেই। আফ্রিকায় প্রায় সর্বত্রই সর্প দেবতা রয়েছে। ভারতবর্ষের সর্প পূজা মূলতঃ সর্পদেবতারই পূজা। বাংলাদেশে মনসা সর্প দেবী হিসেবে পূজিতা হয়ে আসছে। দেবীর উদ্দেশ্যে মহাত্ম্যকীর্তন ও স্তুতিবাক্য হতে পরবর্তীকালে রূপান্তরিত হয়ে রয়ানী সংগীতের উৎপত্তি ঘটেছে এ কথা বলা যায়। লোকসমাজে প্রচলিত এই কাহিনীগুলোকেভিত্তিকরে মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পরিসর মঙ্গল কাব্যের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে।
বরিশাল অঞ্চল খাল-বিলে পরিপূর্ণ। এখানকার আবহাওয়া আর্দ্র এবং মাটি খুবই স্যাঁতসেঁতে। এমনিতর পরিবেশ সাপ বসবাসের জন্য খুবই উপযোগী। তাই এ অঞ্চলে সাপের প্রকোপও খুব বেশী। অধিকন্তু এই বিস্তৃত নিম্মাঞ্চল একসময় সুন্দরবনেরইঅংশ ছিল। ফলে অত্যন্ত মারাত্মক বিষধর সর্পকূলের সমারোহ ঘটেছে এখানে। দক্ষিণ বাংলার এই ভৌগোলিক পরিবেশ যেখানে যে কোন অসতর্ক মুহুর্তে সর্পাঘাতের আশংকা বর্তমান। সেখানে এই বিশেষ নিসর্গ পূজাভিত্তিক সংগীতের প্রসার একান্তই স্বাভাবিক।
দক্ষিণ বাংলার ঘরে ঘরে এ সংগীত পরিবেশিত হত এক সময়ে। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে এ গানের স্রোতা। প্রতিবছর বিশেষতঃ বর্ষার (আষাঢ় ও শ্রাবণ) আগমনে যখন সাপের অত্যাচার বৃদ্ধি পায় তখন এ অঞ্চলের গ্রামে-গ্রামে এমন কি প্রায় পরিবারে মনসা পূজা কিংবা মনসার মহাত্ম্য পরিবেশিত হত। শ্রাবণ মাসের প্রথম থেকে শেষ দিন পর্যন্ত শ্রদ্ধা, ভয় ও শুভকামনায় মনসায় গুণ ও কাহিনী কীর্তিত হয়। রয়ানীকাররা তখন দিবারাত্র সংগীতাকারে রয়ানী পরিবেশন করে যেমন-
...এই না শ্রাবণ মাসেঘণ বৃষ্টি পড়ে।কেমন করে থাকবো লো আমিঅন্ধকার ঘারে।সোনার বরণ লখাইরে আমারবরণ হইলো কালোকিনা সাপে দংশিল তারেতাই আমারে বল।...
বর্ষণমূখর দিনের অবিশ্রান্ত ধারার সাথে এ গানের সুর একই সূত্রে গাঁথা। বৃষ্টির রিম-ঝিম শব্দের তালে তালে মানুষের অশ্র“পাতের মতই এ গান করুণরসের সঞ্চার করে। এ গান একান্তভাবেই আঞ্চলিক এবং প্রকৃতিজাত। এ ছাড়াও স্থানীক ভিন্নতাও রয়ানী সঙ্গীতের আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতার জন্য অনেকাংশে দায়ী। রয়ানীর বিষয়বস্তু, স্থান, ঘটনাপ্রবাহ ও বিশ্লেষণ এবং চরিত্র চিত্রনে একান্তভাবেই দক্ষিণাঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি, লোকমানস, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, জনপদকেই উপস্থাপিত করা হয়েছে যেন।
কবি বিজয় গুপ্তের পরিচয় এবং মনসা মঙ্গল কাব্যের রচনা বিষয়ে বিদগ্ধপণ্ডিত শ্রী জয়ন্ত কুমার দাশগুপ্ত তাঁর লেখায় উল্লেখ করেন, ফুল্লশ্রী গ্রামে শ্রেষ্ঠ কবি বিজয়গুপ্ত জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন হুসেন শাহের পূর্ববর্তী নবাব মজাফফর হোসেনের রাজত্বকালে। কবি যখন পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করেন তখন মুজাফফর হোসেন গত হইয়াছেন এবং হুসাইনশাহ বাংলার মসনদে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিলেন। তাহার কবি পরিচিতি এবং মনসামঙ্গল কাব্য গ্রন্থ রচনা করার উদ্দীপনা যখন কবি স্বপ্নে মনসাদেবী কর্তক উপদিষ্ট হইয়াছিলেন তখন বাংলার মসনদে হুসেন শাহের প্রতিভা উদয়ের ভূমিকা অতিক্রম করিয়া মধ্যাহ্নের পরিপূর্ণ ঐশ্বর্য্যরে দিকে ধাবিত হইয়াছিল। দেশের শ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে কবি বিজয় গুপ্ত হুসেন শাহের দপ্তর হইতে ‘‘ছোট বিদ্যাপতি” উপাধি লাভ করিয়াছিলেন। হুসেন শাহের বর্র্ণনা প্রসঙ্গে কবির অভিব্যক্তি-
‘‘সংগ্রামে দুর্জয় রাজা প্রভাতের রবি।নিজ বাহুবলে রাজা শাসিল পৃথিবী।”
কাব্য গ্রন্থ রচনাকাল বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে কবির বর্ণনাঋতু শশী বেদ শশী পরিমিত শক।সুলতান হুসাইন শাহ নৃপতি তিলক ॥
ঋতু ছয়, শশী এক, বেদ চার এবং শশী এক অর্থাৎ ১৪১৬ শকে কবি তাহার গ্রন্থ প্রনয়ণ করিয়া ছিলেন। উহা ইংরেজি ১৯৯৪ খ্রীঃ সুতরাং কবির গ্রন্থ রচনাকাল পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে। ফুল্লশ্রীর পার্শ্ববর্তী গ্রমের নাম গৈলা। নবাবী আমলে গৈলার সমস্ত পরিসর জুড়িয়া নবাব সৈন্যের সেনানীবাস এবং গোলাবারুদ তৈরীর কারখানা ঘর ছিল। তাই স্থানের নাম গোল হইতে গৈল রূপ পরিগ্রহ করিয়াছিল। তাহার পার্শ্ববর্তী ফুল্লশ্রী গ্রামখানি সূর্যোদয়ের প্রস্ফূটিত সদ্য পদ্মফুলটির ন্যায় শোভাসম্পদ বা শ্রী সমন্বিত ছিল বলিয়া মনসাদেবীর আশীর্বাদপুষ্ট এই বাসভূমিখানির নাম মানসী ফুল্লশ্রী বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। মনসাদেবীর অধিষ্ঠান হেতু মানসী এবং প্রস্ফুটিত শতদলের শোভা সম্পদে ভরপুর এই গ্রামখানির নামকরণ মানসী ফুল্লশ্রী হইয়াছিল। কবি বিজয়গুপ্ত গৈলা নিবাসী ভবদাশ বংশের দৌহিত্র ছিলেন। প্রাচীনকালের প্রথা অনুসারে বিবাহ প্রসঙ্গে বাসভূমি ও বাসগৃহ কন্যা সম্প্রদানকালে যৌতুকস্বরূপ কন্যার পিতার দান করার প্রথা ছিল। সনাতন গুপ্ত নামধারী এক বৈদ্য পাত্রের সহিত রঘুরাম দাশ তার কন্যা রুক্সিনীদেবীর বিবাহ প্রসঙ্গে ফুল্লশ্রী গ্রামের খানিক ভূমি বর কনেকে দান করিয়াছিলেন। কবি বিজয়গুপ্ত অপুত্রক ছিলেন তাই নিজ সমস্ত বসতবাটী তিনি মনসা দেবীর নামে উৎসর্গ করিয়াছিলেন। আজও তাহার ভূমির সীমা মনসাবাড়ী বলিয়া পরিচিত। মন্দিরের পার্শ্ববর্তী ভূমিতে কিছুকাল পূর্বেও কবির বাস্তভিটা সযত্নে সংরক্ষিত ছিল। দেশ বিভাগের পরে উহা জঙ্গলে পরিণত হইয়াছে। নিজ পরিচয় সূত্র নির্দেশ প্রসঙ্গে কবি লিখিয়াছেন-
‘‘সনাতন তনয় রুক্সিনী গর্তজাত।সেই বিজয় গুপ্তেরে রাখ তব সাথ ॥”
প্রবাদ আছে যে কবি বিজয়গুপ্ত গ্রন্থ রচনার পরে তাহার মাতুল ত্রিলোচন দাশ কবি রতœকে গ্রন্থের বা লেখার শুদ্ধাশুদ্ধি বিচার করিয়া দেখার জন্য অনুরোধ করিয়াছিলেন। কিন্তু পুস্তকখানির বা গ্রন্থখানির শুদ্ধাশুদ্ধির বিচার করিতে বসিলে মনসামন্দিরের পূজারী রামটুরী চক্রবর্তী মহাশয়ের বিধবা কন্যা আসিয়া তাহাকে বলিলেন, ‘‘শুদ্ধাশুদ্ধ বিচার করিবার প্রয়োজন নাই পুথি বা গ্রন্থে অশুদ্ধির লেশমাত্র নাই। সুতরাং শুদ্ধ করিবার কোন প্রয়োজন নাই। ইহা বলিয়াই মেয়েটি আপন কার্যে স্থানান্তরে চলিয়া গেল। মেয়েটি চলিয়া গেলে কবিরত্ন মহাশয়ের যেন সম্বিত ফিরিয়া আসিল। অশিক্ষিতা গ্রাম্য বালিকার এই গর্বোস্ফিত নির্দেশ তাহার পাণ্ডিত্যের অভিমান জাগাইয়া তুলিল। তিনি মেয়েটিকে পুনরায় ডাকিয়া পাঠাইলেন কিন্তু খোঁজ করিয়া জানা গেল যে মেয়েটি বৎসরাধিক কাল পর্যন্ত তাহার শ্বশুরালয়ে অবস্থান করিতেছে। তখন আশ্চর্যান্বিত হইয়া তিনি পুস্তক শুদ্ধির প্রসঙ্গ হইতে বিরত থাকিলেন এবং কবির স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশ অনুধাবন করিয়া পুস্তকখানি সব শুদ্ধ আছে বলিয়া ফেরৎ দিয়া দিলেন।
স্বপ্ন অধ্যায়ে আছে-
‘‘না লবে গীতের দোষ পণ্ডিত যেবা হয়।মোর গীত শুনি যার হৃদয়ে কৌতুক।মোর বরে হবে তার মহাধন সুখ ॥অহংকারে মোর গীত করে উপহাস।মোর কোপে হবে তার সবংশে বিনাশ ॥”
বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের ফুল্লশ্রী গ্রামে জন্মগ্রহণকারী কবি বিজয়গুপ্ত রচিত মনসা মঙ্গলই বৃহত্তর বরিশাল এবং তার আশপাশ অঞ্চলে গাওয়া হয়ে থাকে। সাধারণত শ্রাবণ মাসব্যাপী এ গান গাওয়া হয়। এ গানের শিল্পি ঘরের গৃহিনীরা। প্রত্যহিক গৃহকর্ম শেষে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে মনসা মন্দিরের চত্বরে বা বারান্দায় হোগলা-মাদুর পেতে বসে রয়ানির আসর। শ্রোতা, আশপাশের শিশু-কিশোর থেকে বয়োবৃদ্ধরা পর্যন্ত। বরিশাল নগরীতে এসময়েও ৮/১০ স্থানে রয়ানীর আসর বসতে দেখা যায়। তবে শ্রোতার সংখ্যা নেই বললেই চলে। বেহুলা-লক্ষীন্দরের কাহিনীর মায়াজাল বা সুরের বৈচিত্র নয়, নয় শ্রোতাদের মনজয়ের আশায়, আজকে গাওয়া রয়ানীÑ সর্পদেবী মনসাকে তুষ্ট করার জন্যই গাওয়া হয়ে থাকে এমন ধারণা শিল্পিদের। তবে অনেক হিন্দু পরিবারে মনোবাঞ্ছা পূরণের আশায় ২/৩ দিনের রয়ানীর মানত করেন। আর মানতের রয়ানী পরিবেশিত হয়ে থাকে জাক্জমকভাবে। বাড়ে প্রসাদের পরিমাণ। বরিশালের আগৈলঝাড়া-উজিরপুর-গৌরনদী উপজেলায় সব মিলিয়ে গোটা চারেক রয়ানীর দল রয়েছে। এর মধ্যে নিমাই দেউরি ও সুমালা’র দলের নাম ও পরিবেশনা স্থানীয়দের কাছে সুপরিচিত। এছাড়াও আগৈলঝাড়া এলাকার কোদালধোয়া গ্রামের সুধীররঞ্জন কীর্তনীয়ার দলের পরিবেশিত রয়ানীও স্থানীয়দের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য। দলগুলো রয়ানীকে আধুনিক ফর্মে নিয়ে এসেছেন পরিবেশনার দিক থেকে। তাদের পরিবেশনায় সুরের বৈচিত্র প্রবল। উপস্থাপনেও রয়েছে নাটককিয়তা।
শিল্পিদের সাজসজ্জায় ধর্মীয় প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কবি বিজয় গুপ্তের জন্মস্থান গৈলার মনসা মন্দিরে বার্ষিক পূজা উপলক্ষে রয়ানীর আসর বসে। এছাড়া শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে রয়ানী দলের বায়নাও বেশি। রয়ানি পরিবেশন করেন সাধারণত ১০ থেকে ১৫ জনের দল। মূল গায়েনকে সরকার বলে অভিহিত করা হয়। কেউ কেউ বলেন গায়েন। যন্ত্রশিল্পিরা খোল, সানাই, করনেট, করতাল, বাঁশি, হারমোনিয়াম দ্বারা গায়েনকে সঙ্গত দেন। দলে ৫/৬জন দোহারও থাকেন।
কালের আবর্তে রয়ানী পরিবেশানার সময়কাল আজ সংক্ষিপ্ত হয়ে এসেছে। সাধারণ গৃহিনীদের গাওয়া মনসা মঙ্গল আর নিমাই দেউরি-সুমালা-সুধীররঞ্জনদের গাওয়া রয়ানীর পার্থক্য অনেক। এপার্থক্য সময়-সুর-পরিবেশনার ঢং-বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার-পোষাক ও পরিচ্ছদ-দর্শক শ্রোতার সংখ্যাতে সুস্পষ্ট। পার্থক্য যাই হোক না কেন, মধ্যযুগ থেকে রয়ানী টিকে আছে তার বৈচিত্রপূর্ণ ব্যঞ্জনায়, আগামীতেও টিকে থাকবে শেকরসন্ধানী মানুষের প্রেরণা-উৎসাহ আর লোক মানসে প্রোথিত কাহিনীর পরম্পরা-ট্রাজেডি ও মানুষের সফলতার জয়গানে। মনসা মঙ্গলের বাণী ও সুর যে- দেবতার প্রতি মানুষের চ্যালেঞ্জ এবং মানুষেরই জয়গাথা, তাই মানুষই টিকিয়ে রাখবে রয়ানীর সুর-বাণীর ঝরণা ধারাকে।
বাঙালি জীবনের স্বতঃস্ফুর্ত প্রেরণা এসব সংগীত আমাদের যথার্থ ঠিকুজি। তাই লোকসংগীত সংগ্রহ, সংরক্ষণ, উপস্থাপনা, গবেষণাসহ সার্বিক আবিস্কারের মাধ্যমেই আমাদের জাতিসত্তার স্বরূপ উন্মোচনে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণে সদিচ্ছা থাকতে হবে।
No comments:
Post a Comment