নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না। কর্তব্য ছিল বলেই বাংলা ভাষা আদায়ের আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। তারপর এ নিয়ে নিজে যাচিয়ে খুব হৈ-চৈ করেনি। সদর উপজেলার দিনারের পুল এলাকার বাসিন্দা তিনি। সবাই চেনে তোফায়েল-ই-আলম প্রফেসর নামে। কিন্তু ভাষা আদায়ে এই যোদ্ধার অজানা অধ্যায় এতদিন ছিল অগোচরে। সম্প্রতি তার পুত্রের মুখে জানতে পেরে মুখোমুখি হয়েছিলাম ভাষা যোদ্ধার সাথে। নব্বই পেরিয়ে যাওয়া মহান মানুষটি কানে কম শুনছেন, শারিরীক দিক থেকেও অনেকটা অসুস্থ। তবে শোনালেন ৫২’র সেই সব স্বর্ণালী যুদ্ধের বীরত্ব গাঁথা।
সৈয়দ মেহেদী হাসান:
আমরা জেনেছি
আপনি ৫২’র ভাষা
আন্দোলনের মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিলেন...
তোফায়েল-ই-আলম:
আমি তখন
এম.কম
সেকেন্ড পার্টের
ছাত্র। থাকতাম
ফজলুল হক
হলের এক্সটেনশন
ঢাকা হলে।
পূর্ব অংশটা
হিন্দু ছাত্রদের
জন্য বরাদ্দ
ছিল। হিন্দু
ছাত্র কমে
যাওয়ায় মুসলমান
ছাত্রদের দেয়া
হয়েছিল। সেখানে
ছিলাম এবং
আন্দোলনের মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিতাম।
সৈয়দ মেহেদী হাসান:
ভাষা আন্দোলন
হল দীর্ঘ
৬৪ বছর
পূর্বে। এতদিন
এই বিষয়টি
কাউকে বলেননি?
তোফায়েল-ই-আলম:
এখানে আমার
মন্তব্য হল,
আন্দোলনের মিছিলে অংশ নেয়াটা ছিল
দায়িত্ব। ভাষার
জন্য মিছিল
মিটিং হত।
সেখানে অংশ
নেয়ায় বলে
বেড়ানোর কিছু
আছে বলে
মনে করি
না। মিছিলে
থেকে যে
বৃহৎ অবদান
রেখে ফেলেছি
সেটা কখনোই
ভাবি না।
আসলে বাংলা
ভাষার দাবীতে
রাজপথে নেমে
আসাটা ছিল
আমাদের কর্তব্য।
আমি কর্তব্য
পালন করেছিলাম
মাত্র।
সৈয়দ মেহেদী হাসান:
ঐ দিনের
পরিস্থিতি সম্পর্কে যদি কিছু বলেন
তোফায়েল-ই-আলম:
আমাদের নেতৃত্বস্থানীয়
ছিলেন আঃ
মতিন, গাজীউল
হক। ওনারা
একটু সিনিয়র
ছিলেন। হলগুলোতে
আগে থেকেই
১৪৪ ধারা
ভাঙ্গার প্রস্তুতি
চলছিল। ২১
ফেব্র“য়ারি
সকালে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় এরিয়ায় একটি বড় মিছিল
করি। এখনতো
আন্দোলনের চরিত্র এগ্রেসিভ হয়েছে। ঐ
সময়ে জোরালো
আন্দোলন হলেও
অতটা ধ্বংসাত্মক
ছিল না।
সকাল থেকেই
রিকশার চাকার
হাওয়া ছেড়ে
দেয়া, অন্যান্য
গাড়ি আটকে
রাখতাম। বিকেলে
জগন্নাথ হলে
সরকারী সেশন
চলছিল। আমাদের
টার্গেট ছিল
সেই সেশনে
প্রবেশ করা।
মেডিকেলের সামনে থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল বের
হয়ে জগন্নাথ
হলের দিকে
এগোচ্ছিল। তারই একটি মিছিলে গুলি
করে পুলিশ।
আমার গ্রামের
বাড়িতে খবর
ছড়িয়ে পড়ে
যে আমিও
গুলিতে নিহত
হয়েছি। সংবাদ
পেয়ে বাড়ির
লোক গিয়ে
আমাকে পায়।
সৈয়দ মেহেদী হাসান:
ঐ দিনের
মিছিলে আপনি
অংশগ্রহণ করেছেন,
এর পিছনে
শুধুমাত্র কি ভাষা রক্ষার টান
ছিল নাকি
পাকিস্তানের শোষণের বিররুদ্ধে ব্যক্তিগত পর্যায়
থেকে প্রতিবাদে
নেমে এসেছিলেন?
তোফায়েল-ই-আলম:
খুব বেশি
হিসাব নিকাশ
করে তো
কেউ মিছিলে
নামে না।
আমিও তেমনি।
ভাষার জন্যই
মূলত রাজপথে
নেমেছিলাম। রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ
প্রতিটি হলে
ছাত্রদের বুঝাতে
লাগলো বাংলাদেশ
নিয়ে যাবে
পাকিস্তানীরা। উর্দু আমাদেরও বলতে হবে।
এর বিরুদ্ধে
ছাত্ররা না
দাড়ালে দেশতো
পাকিস্তান নিয়ে যাবে গোপনে এমন
একটি ধারণা
ছড়িয়ে দেয়ায়
আমরা ক্ষুব্ধ
হই এবং
আগ-পাছ
না ভেবেই
১৪৪ ধারা
ভাঙতে নেমে
আসি।
সৈয়দ মেহেদী হাসান:
আপনারা কি
জানতেন, মিছিলে
গুলি হবে?
তোফায়েল-ই-আলম:
অনেকে আশঙ্কা
করেছে কিন্তু
সেটা ভেবে
দেখার সময়
ছিল না।
সৈয়দ মেহেদী হাসান:
যারা শহীদ
হয়েছেন তারা
কি কেউ
মিছিলের নেতৃত্বে
ছিলেন?
তোফায়েল-ই-আলম:
না। যারা
শহীদ হয়েছেন
তারা পাবলিক
এবং সাধারণ
ছাত্র। মিছিলটির
নেতৃত্বে ছিল
মতিন, গাজীউল
হক সহ
বেশ কয়েকজন।
সবগুলো নাম
মনে পড়ছে
না।
সৈয়দ মেহেদী হাসান:
আপনি কি
কোন দায়িত্বে
ছিলেন?
তোফায়েল-ই-আলম:
বিশেষ কোন
দায়িত্ব ছিল
না। আমিতো
সাধারণ ছাত্র
ছিলাম। রাজনীতি
করতাম না।
তবুও একটু
দায়িত্ব ছিল,
পতাকা বিক্রি
করতাম। পতাকা
বিক্রি করে
মিছিলের টাকা
জোগাতাম।
সৈয়দ মেহেদী হাসান:
কতজনে এ
কাজ করতো?
তোফায়েল-ই-আলম:
অনেকেই ছিল।
অত নামতো
বলতে পারছি
না।
সৈয়দ মেহেদী হাসান:
ভাষা আন্দোলনে
গেলেন যে
স্বপ্ন নিয়ে
এখন বর্তমান
বাংলাদেশে তা কতটা পূরণ হয়েছে
বলে মনে
করেন?
তোফায়েল-ই-আলম:
রাজনৈতিক নেতারা
তাদের প্রয়োজন
মেটাতে কথা-বার্তা বলে।
মানুষের কথাতো
বলছে না।
তবুও একেবারে
হতাশ না।
দেশ ক্রমান্বয়ে
এগিয়ে যাচ্ছে
এটা অনেক
পাওনা। তবে
হতাশা হয়
সর্বস্তরে বাংলা আজও হয়নি। আশা
করি ধীরে
ধীরে হলেও
তা বাস্তবায়ন
হবে।
সৈয়দ মেহেদী হাসান:
লেখাপড়া করেছেন
কোথায়?
তোফায়েল-ই-আলম:
দিনারের পুল
সরকারী প্রাথমিক
বিদ্যালয় থেকে
প্রাথমিক, বরিশাল এ.কে. স্কুল
থেকে মেট্রিক,
বি.এম
কলেজে আই.কম এবং
ঢাকা ইউনিভার্সিটি
থেকে বি.কম, এম.কম।
সৈয়দ মেহেদী হাসান:
বিএম কলেজে
এক সময়ে
শিক্ষক ছিলেন...
তোফায়েল-ই-আলম:
সন তারিখ
মনে নেই।
১৯৫৫ সালের
দিকে হবে।
সৈয়দ মেহেদী হাসান:
১৯৭১ সালে
আন্দোলনের সময়ে আপনার সাথে বরিশালের
আর কেউ
কি ছিল?
তোফায়েল-ই-আলম:
হ্যাঁ ছিল।
সৈয়দ আশরাফ
হোসেন, আঃ
লতিফ, নূর
মোহাম্মদ। সৈয়দ আশরাফ হোসেন বেঁচে
নেই। উনি
কর্ম জীবনে
ও জন্মসূত্রে
পটুয়াখালীর। বাম রাজনীতি করতেন। আঃ
লতিফের বাড়িও
বাউফলে এবং
সৈয়দ মোয়াজ্জেম
হোসেন যিনি
মহিলা কলেজের
প্রিন্সিপাল ছিলেন। মারা গেছেন। নূর
মোহাম্মদের খবর জানি না।
সৈয়দ মেহেদী হাসান:
পাঠকের উদ্দেশ্যে
কিছু বলবেন
কি?
তোফায়েল-ই-আলম:
বলার কি
আছে, আমার
বিশ্বাস ’৫২,
’৭১ এর
চেতনা ধারণ
করে এগিয়ে
যাবে। বাংলাদেশ
সোনার দেশ
হবে।
সৈয়দ মেহেদী হাসান:
এত বৃদ্ধ
বয়সে কষ্ট
করে হলেও
আমার সাথে
কথা বলার
জন্য আপনার
প্রতি শ্রদ্ধা
ও কৃতজ্ঞতা
রইল।
তোফায়েল-ই-আলম:
আপনাকেও অনেক
ধন্যবাদ।
No comments:
Post a Comment